আমি সেই মধ্যবিত্ত ।।

Bangla circle news

আমি সেই মধ্যবিত্ত ।।

রজত চক্রবর্তীর কলমে।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো আমি আজ পর্যন্ত কোনোদিন কোনো রাজনীতি করিনি। ভোট দিয়েছি পছন্দ অনুযায়ী। আমি সেই মধ্যবিত্ত যে SSC দিয়ে শিক্ষক হয়েছি এই বঙ্গে, হ্যাঁ মাইনে ভালোই পাই, হ্যাঁ বামফ্রন্ট আমলেই। আমি সেই মধ্যবিত্ত যে অধ্যাপক হয়েছি স্লেট দিয়ে, হ্যাঁ মাস্টার্স পিএইচডি এই বঙ্গেই ঠিকঠাকভাবেই করেছি, হ্যাঁ বামফ্রন্ট আমলেই। নাঃ কোনো পার্টির মিটিং মিছিলে যাইনি। হ্যাঁ স্কুল-কলেজে-অফিসে সংগঠনের চাঁদা দিয়েছি। ব্যাস্। আমি সেই মধ্যবিত্ত যে জয়েন্ট দিয়ে এই বঙ্গেই এঞ্জিনিয়র হয়েছি, এখানেই ডাক্তারি করছি। আমি সেই মধ্যবিত্ত PSC দিয়ে সরকারি চাকরি করছি। নাঃ কোনো দাদা দরকার হয়নি চিনিও না। হ্যাঁ আমি কোনো রাজনীতি করিনি করিওনা।
আমি সেই মধ্যবিত্ত যে বামফ্রন্ট আমলেই ছাত্র এবং বামফ্রন্ট আমলেই প্রতিষ্ঠিত। হ্যাঁ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত আমি একটু উচ্চবিত্ত হয়েছি সেই আমলেই। আমার একটাই সমস্যা হয়েছিল। কলেজে, স্কুল বা অফিসে নেতাগুলো বড় অহংকারী। ইগোয় লাগত খুব। তর্ক করে যেন সবজান্তা! উদ্ধত, সব বোঝে তারা কিউবা থেকে গোসাবা, আমরা যেন কলাপাতার সার্টিফিকেটে চাকরি করছি। এই একটাই আমার অসুবিধা ছিল। অস্তিত্বের সংকট নয়, অস্তিত্ব সুরক্ষিত ছিল, অস্তিত্বের মানসিক সংকটে ভুগছিলাম। মধ্যবিত্ত বড় মানসিক ভাবে ত্রস্ত!
আমি সেই মধ্যবিত্ত ডাল-ভাত-মাছ সুরক্ষিত রেখে, এসির সুইচ অন রেখে, তেলে-বেগুন হয়ে উঠতাম স্থানীয় নেতাদের হেক্কাড়ে! ইগোয় লাগত খুব! বিশ্বাস করুন, আমি কোনোদিন রোদে-জলে মিছিলে যাইনি, পুলিসের বাটাম খাইনি, সারারাত ধর্না দিইনি…আমি সুপ্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত নিজের ক্ষমতার বলে ( যদিও চাকরির পরীক্ষা গুলো হবার জন্য একটা সরকার ছিল)…খুব রেগে যেতাম। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে। সিপিএমের বিরুদ্ধে। আমি সুপ্রতিষ্ঠিত একজন মধ্যবিত্ত।
নন্দীগ্রামের পর যখন বুদ্ধিজীবীর দল রে রে করে নেমে পড়ল রাস্তায় তখন আমিও নেমে পড়লাম রাস্তায়। শালাদের শাস্তি দিতে হবে! আমার অফিস সংগঠনের সেক্রেটারি, আমার কলেজের সভাপতি, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি শালাদের কড়কে দেওয়া দরকার। এতো বড় সাহস! দেশে আইন নেই! নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা বলে যা পারবে করবে! আমরা শিক্ষিত সমাজ গর্জে উঠলাম, দ্যাখ কেমন লাগে! বিশ্বাস করুন, ক্ষোভ উগরে দিলুম। এগারো সালে লাইন দিয়ে ভোট দিলুম দিদির পায়ে।
পাড়ার অশিক্ষিত ‘পচা’কে করে দিলুম পাড়ার ক্লাবের সেক্রেটারি। বিমানবাবু বাদ। খুব আমোদ হল – শালা সাদা পাঞ্জাবী পরে দাঁত চিবিয়ে কতা! আমি সেই মধ্যবিত্ত। ব্যালকনিতে বসে মজা পেলাম বিমানবাবুর রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখে আর পচার বাইকের উপর স্নিকার পা দেখে।
আমি সেই মধ্যবিত্ত । আমি দশ বছরে একবার প্রশ্ন করলাম না – নন্দীগ্রামে হাজার হাজার মানুষকে যে মেরেছে তার নামের তালিকা কোথায়?
আমি জিজ্ঞেস করলাম না দশ বছরে – নন্দীগ্রামের ঘটনার পর মমতা সরকারের তৈরী তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট কোথায়?
আমি জিজ্ঞেস করলাম না দশ বছরে – মানবাধিকার কমিশনে দায়ের হওয়া কেসগুলির নিষ্পত্তি হল না কেন ?
আমি জিজ্ঞেস করলাম না দশ বছরে- নন্দীগ্রাম নিয়ে সিবিআই রাজ্য সরকারকে কী রিপোর্ট দিয়েছে?
আমি জিজ্ঞেস করিনি দশ বছরে – যে পুলিশ অফিসারেরা নন্দীগ্রাম কান্ডে যুক্ত ছিলেন তাঁদের প্রমোশন হল মমতার সরকারের আদেশে কী ভাবে? এমনকি কেউ কেউ মন্ত্রী হলেন কী ভাবে? বুদ্ধদেব বাবু বলেছিলেন, দশ বছর বাদে মানুষ বুঝবে কে গুলি চালিয়েছে? আশ্চর্য মাইরি! দশবছর যেতে না যেতেই, এ বলছে ওর গেমপ্ল্যান নন্দীগ্রাম আর ও দুষছে একে! বুদ্ধবাবুদের কথা কেউ বলছে না মাইরি! অবাক! বেড়াল বেইরে পড়েচে!!
আমি সেই মধ্যবিত্ত। একটা ষড়যন্ত্রকে লালন করতে দিয়ে এবং নিজের ভুয়ো ইগোর সন্তুষ্টি করতে গিয়ে ‘আর সব ডুবে যাক’ ধারনায় পেনশনের দিকে এগিয়ে চলেছি।
আজ বুঝতে পারছি, সেইদিনের ভুলের ফলে, আজ আমার ঘরেই বেকার ছেলেমেয়ে। দশ বছরে কোনো চাকরির পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে হল না। দশ বছরে শুধু ডোল হল। বেসিক উন্নতি হল না। আমি সেই প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুঝতে পারছি সেদিনের সিঙ্গুরে কারখানা হতে পারলে আমাদের ভবিষ্যতের প্রজন্মের সুরাহা হত।
আমি সেই মধ্যবিত্ত আবার আবার আরেক ধর্মের আরক পানে ছুটে চলেছি। নাঃ । এবার দাঁড়িয়ে দেখি। প্রায়শ্চিত্ত করার সময় এসেছে। আমার পরের প্রজন্মের জন্য একটা আস্তাকুঁড় বানিয়ে ফেললাম শুধুমাত্র মুহূর্তের মধ্যবিত্ত অহং এর ভুলে। ক্ষমা চাইছি। আজ প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছি। এসেছি শহীদ মিনারে। বিশ্বাস করুন মেট্রো, টাইগার, গ্লোবে সিনেমা দেখতে এসেছি অনেকদিন। ব্রিগেড বা শহীদ মিনারে যাইনি কোনোদিন।
মেট্রোর গলি, বিদেশি জিনিস, মুখস্থ! কিন্তু শহীদ মিনারের সামনেটায় যাইনি কোনোদিন। আজ যাচ্ছি। আমি সেই মধ্যবিত্ত যে কোনো দিন মিছিলে হাঁটিনি, স্লোগান দিইনি, আজ দিলাম শহীদ মিনারের নিচে কর্মচারীদের জমায়েতে। বিশ্বাস করুন, খুব খুব ভালো লাগছিল! একটা প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পেয়েছি, একসাথে বহু মানুষের গলার জোর যেন আমার গলায় শুনতে পেলাম। চমকে উঠেছি। আমি আবার যাবো, ছেলেকে নিয়ে যাবো, মেয়েকে নিয়ে যাবো – অন্তত দেখাতে পারব তোদের জন্য তোদের জন্যই একটা সুন্দর পরিবেশ করার জন্য আমি এই ভিতু আমি, স্বার্থপর আমি, ঘরোয়া আমি পথে নেমেছি। তোরাও চল। সবাই নামি। প্রায়শ্চিত্তর দিন আজ।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *