বাঁকুড়া জেলার ওন্দা ব্লকের অন্তর্গত গোগড়া গ্রামের বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পাতালেশ্বর শিবের আজ রাত্রি গাজন।
বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের রাজত্বকালে যে সকল বাংলায় গাজন উৎসব শুভারম্ভ হয়েছিল তাদের মধ্যে এক এবং অদ্বিতীয় গাজন উৎসব হল গোগড়া গ্রামের পাতালেশ্বর শিবের গাজন।
৫৫ তম মল্ল রাজা গোপাল সিংহ দেব এর রাজত্ব কালে তার অধীনে ১১৩৩ বঙ্গাব্দে(ইং-1727 খ্রিস্টাব্দে) গোগড়া গ্রামে গাজন উৎসব শুরু হয় যা বর্তমানে ২৯৬ বছরে পদার্পণ করছে।
গোগড়া গ্রামের মহাদেব স্বয়ং পাতাল থেকে অবতীর্ণ হয়েছেন বলেই মন্দিরের নামকরণ পাতালেশ্বর নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাই মহাদেবের কৃপাধন্য গোগড়া গ্রাম আজ দেব ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
কথিত আছে গোগড়া গ্রামের একজন অতিব ধর্ম পরায়ণ ভক্তি মার্গের সৎ ও নিষ্ঠাবান দরিদ্র ব্রাহ্মণ তিনি মহাদেবের পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল যাবত ওই গ্রামে বসবাস করতেন। সেই সময় গোগড়া গ্রামে জনবসতি ছিল না বললেই চলে। ব্রাহ্মণ এক আশ্চর্য অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি দেখলেন এক গভীর গর্তে মহাদেবের কালো পাথরের শীর্ষস্থানটি তীব্র দেবো আলোর জ্যোতি প্রকাশ করছে চারিদিক। সেই সময় ব্রাহ্মণ মহাদেবের স্তব আরম্ভ করলেন। পরবর্তীকালে শিবের অলৌকিক তার সাথে ঘটে যাওয়া বিষয়টি তিনি সকলের নজরে আনলেন। এবং তখন থেকে গোগড়া গ্রামে গাজন উৎসব শুরু হয়। সেই সময় গ্রামবাসীদের আর্থিক সহায়তায় ও প্রচেষ্টায় সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটি চুন-সুরকির ইটের তৈরি সুবিশাল এক মন্দির। পরবর্তীকালে মন্দিরটির সংস্কার করা হয়। পরে একটি আট চালাও স্থাপন করা হয়। মন্দিরটি দেখলে যেন মনে হয় বাংলা শৈল স্থাপত্যের সঙ্গে অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গোগড়া গ্রামের গাজন যে বহু পুরাতন তা বলার কোন অপেক্ষা রাখে না। জনশ্রুতি রয়েছে এই পাতালেশ্বর শিবের কাছে ভক্তগণেরা যা মনস্কামনা করেন তার ফলস্বরূপ মহাদেব সকলের মনোবাঞ্ছনা পূরণ করেন।
এই মন্দিরে অবস্থিত পাতালেশ্বর বাবা ভোলানাথের নিয়মিত আচার রীতি-নীতি মেনে নিত্য পুজো হয়ে আসছে বহু যুগ থেকেই। নিত্য পূজারী হিসেবে গোগড়া গ্রামস্থ মুখার্জি পরিবারের উপর দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়। এই উল্লেখিত মুখার্জি পরিবারের কুলো পুরোহিত জয়দেব মুখার্জি দীর্ঘদিন ধরে বাবা পাতালেশ্বর শিবের মন্দিরের সেবাইত হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। এবং পুজো অর্চনা করে আসছেন দীর্ঘকাল থেকেই।
চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকে কাঠি পড়তেই গোগড়া গ্রাম মেতে ওঠেন গাজন উৎসবে। বাংলার গাজন শব্দটি “গর্জন” শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী ভক্তেরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের এইরূপ নামকরণ হয়। আবার অপর মতে, ‘গা’ অর্থে গ্রাম, ‘জন’ অর্থে জনগণ, অর্থাৎ গ্রামের জনসাধারণের উৎসব।
রঘুনাথ চক্রবর্তী, তারাশঙ্কর চক্রবর্তী ও বরেন নন্দী গ্রামের এই তিন বিশেষ ব্যক্তিগণেরা জানান।
রাঢ় বাংলার অন্যতম প্রধান উৎসব ‘গাজন’ আর সেই গাজনকে কেন্দ্র করে এমন উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় গোগড়া গ্রামের জনসাধারণের মধ্যে। প্রতিবছর বাংলা বছরের শেষের তিন দিন ধরে এই গ্রামে জাঁকজমক মহোৎসবে গাজন অনুষ্ঠিত হয়। গাজনের প্রথম দিন থেকে পাটস্নান নামে একটি প্রথা বর্তমানেও চালু আছে। এছাড়াও গামীর কাঁটা, রাজা বাটা ও মা কামাখ্যার দেবীর পুজো গোগড়া গ্রামে মধ্য রাত্রিতে প্রতিষ্ঠিত পুকুর থেকে ক্যামলা হাঁড়ির পূর্ণ জল ভর্তি ঘট নিয়ে পাঠভোক্তা হাঁড়ির সেই পূর্ণ জল উল্টো করে মাথায় নিয়ে আসার রীতি আজ ও বর্তমানে একইভাবে হয়ে আসছে। দ্বিতীয় দিনে রাত গাজন ও তৃতীয় দিন সকালে বাণফোঁড় দিন গাজন ও বিকেলে চড়ক পুজো মানুষের সমাগমে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয়। গোগড়ার আর্গি তোলা থেকে শিবমন্দির পর্যন্ত ভক্তেরা মাটিতে গোড়ান দিতে দিতে আসে মঙ্গল কামনার জন্য।
পাতালেশ্বর শিবকে সারা বছর আগলে রাখেন ব্রাহ্মণেরা, গাজনের কদিন সেই শিব সমাজের নিম্ন কোটির মানুষের হাতে পূজা গ্রহণ করেন। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, জাত নেই, কুল নেই, উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা অবহেলা নেই। এ কদিন সবাই সমান মর্যাদায় সম্মান পায়। এখানেই শৈব সংস্কৃতির সঠিক উত্তরণ। গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে গণদেবতা।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনে দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয় বলে মনে করা হয়। বিবাহ উৎসবে ভক্তেরা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন। গাজন উপলক্ষে ভক্তের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে বর্তমানে ভক্তের সংখ্যা ১৫০ থেকে ২০০ জন হয়ে থাকে। যতদিন যাবে মহাদেবের কৃপায় ভক্তে র সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে আগামী দিনে।
স্বপন পরামানিক, উত্তম ভট্টাচার্য্য, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ও সমু ভট্টাচার্য্য গ্রামের বিশেষ ব্যক্তিগণরা জানান
চড়ক ও গাজন গোগড়া গ্রামের এক বিশেষ উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। গ্রামের গাজন ও চড়ক ঢাকের তালে সঙ্গে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সমারোহে খুব জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। পিঠে গামছা বেঁধে চড়কে পাক খাওয়ার প্রচলনও রয়েছে এখানে। ওন্দা র পার্শ্ববর্তী গ্রাম ছাড়াও জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষের সমাগম ঘটে এই গাজনে। এছাড়াও বাঁণফোড়, আগুন সন্ন্যাসী, পঞ্চমুখী বান বিভিন্ন বাঁণফোড় হয়ে আসছে পূর্ব কাল থেকেই। গাজন উপলক্ষে গোগড়া গ্রামের এক বিশেষ ঐতিহ্যের সংস্কৃতি রয়েছে তা হল সঙ সাজার রীতি। যা দীর্ঘকাল যাবত হয়ে আসছে। বিভিন্ন দেব-দেবীর আদলে একজন শিব ও অপরজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্যান্য ভক্ত্যারা রামচন্দ্র, লোকনাথ, নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে সঙ্গে নাচতে থাকে। এই ঐতিহ্যের সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ধারাবাহিকতা রয়েছে বহু কাল থেকেই। গোগড়া গ্রামের এই সম্প্রীতি মেলবন্ধন যেন মিলেমিশে একাকার। শিব মন্দির থেকে শোভাযাত্রা বের করে আনন্দ সমারোহে গ্রামের সকলে মিলে ওন্দা র গ্রামান্তরে ঘুরতে থাকে। চড়ক দেখতে আশা মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা থাকে চোখে পড়ার মতো। তাই গাজন ও চড়কে কেন্দ্র করে গোগড়া গ্রামে একটি মেলাও বসে। বাংলা বছরের শেষ দিনে বাংলার এই উৎসব আসলে মিলনের উৎসব। সব ভেদাভেদ ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আগে মহা-মিলনই হল এই গাজন উৎসব।
তাই মহাদেবের কৃপাধন্য ওন্দা র গোগড়া গ্রাম বাঁকুড়া জেলার মধ্যে এক পুণ্যস্থান শিব মন্দির হিসেবে বর্তমানে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।

Leave a Reply